সম্প্রীতি

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা - | NCTB BOOK
23
23

এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ধারণা নিতে পারব - 

■ সম্প্রীতি কী;

■ বৌদ্ধধর্মে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব; 

■ সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সুফল।

মানুষ কখনও অপরের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া একা জীবন যাপন করতে পারে না। মানুষকে পরিবার পরিজন নিয়ে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে হয়। সমাজবদ্ধ হলে মানুষ নির্ভয়ে, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতে পারে। এ কারণে প্রতিটি মানুষ নিজের পরিবারের যেমন অংশ তেমনি সমাজেরও অংশ। তাই প্রতিটি মানুষের আছে একটি পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। এটিই মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষ নিজের পরিবারের ভাল-মন্দ যেমন চিন্তা করে, তেমনি সমাজ, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় ও দেশের মানুষের কল্যাণের কথাও ভাবে। এই মানবীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ যখন একটি দেশে মিলেমিশে সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে বসবাস করে তখন সৃষ্টি হয় জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলে। দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ না থাকলে একটি জাতি সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না। জাতীয় উন্নয়নে সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এ কারণে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সম্প্রীতিবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়।

সম্প্রীতি কী

সম্প্রীতি মানে হলো অপরের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা। সবসময় সদ্ভাব বজায় রেখে মিলেমিশে বসবাস করা। প্রীতিময় ও শান্তিময় সহাবস্থান করা। সম্প্রীতি সহাবস্থানের পূর্বশর্ত। সম্প্রীতি এক প্রকার সদগুণ এবং একটি গুরত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই সম্প্রীতিভাব তৈরি হয়। ধর্ম, বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে মিলেমিশে জীবন অতিবাহিত করাই হলো সম্প্রীতি। বৌদ্ধধর্মে সম্প্রীতির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, ‘সমগ্গানং তপো সুখো’। অর্থাৎ. সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকাই উত্তম সুখ। একসাথে মিলেমিশে বসবাস করার মধ্যে বিশেষ আনন্দ আছে, সুখ আছে, শান্তি আছে। সম্প্রীতি বিনষ্ট হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, অশান্তি ও ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। নিজে পরিবার এবং সমাজে যেমন সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে ও সম্প্রীতি বজায় রাখা উচিত।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৪৩

সমাজে সকল মানুষের জন্য কী কী কাজ করা যায়, তার একটি তালিকা তৈরি করো।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

বৌদ্ধধর্মে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব

সম্প্রীতির অনুশীলন নিজ থেকেই শুরু করতে হয়। নিজে সংযম, উদারতা এবং সম্প্রীতি চর্চা করলে কারো সাথে কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় না। সে জন্য সম্প্রীতি রক্ষার জন্য করণীয় আচরণ সম্পর্কে তথাগত গৌতম বুদ্ধ বলেছেন :

ন চ খুদ্দং সমাচরে কিঞ্চি যেন বিষ্ণুপরে উপবদেযং,

সুখিনো বা খেমিনো হোন্তু, সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখিতত্তা।

এর বাংলা হলো - এমন কোনো ক্ষুদ্র আচরণ করো না, যার জন্য অপর কোনো বিজ্ঞজন নিন্দা করতে পারে। সর্বদা মনে এই চেতনা পোষণ করতে হবে যে, সকলেই সুখী হউক, নির্ভয় হউক, ও মানসিক সুখ ভোগ করুক।

এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ আরো বলেছেন -

ন পরো পরং নিকুব্বেথ,

নাতিমঞেথ কখচি নং কঞ্চি ;

ব্যারোসনা পটিঘসজ্ঞা নাঞ মঞস্প দুৰ্খমিচ্ছেয্য।

অর্থাৎ, একে অপরকে কখনো বঞ্চনা করবে না, কাউকে অবজ্ঞা করবে না। এমনকি আক্রোশ বা হিংসাবশত কারো দুঃখ কামনা করবে না।

বৌদ্ধধর্ম মতে, সকলের সাথে সমন্বয় সাধনপূর্ণ সংহতিপূর্ণ আচরণ করা মানুষের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। সংহতিপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে জীবন যাপন করার মধ্যেই প্রকৃত সামাজিক সুখ ও আনন্দ । তাই সকল প্রাণী বা সত্তার সুখ ও আনন্দকে এক সূত্রে গ্রথিত করে বুদ্ধ বলেছেন -

সব্বে সত্তা সৰ্ব্বে পানা সৰ্ব্বে ভূতাচ কেবলা,

সব্বে ভদ্রানি পস্সন্তু মা কঞ্চি পাপমাগমা।

অর্থাৎ জগতের সকল সত্তা তথা সকল প্রাণী সর্বতোভাবে মঙ্গল দর্শন করুক, কেউ কোনো প্রকার অমঙ্গলের সম্মুখীন না হোক। তিনি আরো বলেছেন -

সুসুখং বত জীবাম বেরিনেসু অবেরিনো,

বেরিনেসু মনুস্পেসু বিহরাম অবেরিনো।

অর্থাৎ এসো, আমরা বৈরীদের মধ্যে অবৈরী আচরণ করি, হিংসাকারীদের মধ্যে এসো আমরা অহিংস হয়ে সুখে জীবন ধারণ করি। তাহলে আমাদের মনে কখনো কোনো ভয়, ভীতি ও শঙ্কা থাকবে না। জীবন হবে শান্তিময় ও মঙ্গলময়। তাই আমাদের জীবনে সম্প্রীতি চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৪৪

এখান থেকে যে কোনো একটি কাজের ছবি এঁকে কর পাশের খালি স্থানে বসাও ।

১. অসুস্থ মানুষদের সেবাকাজ। 

২. শিশুদের জন্য খাবার পরিবেশন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এখান থেকে যে কোনো একটি কাজের ছবি এঁকে পাশের খালি স্থানে বসাও। 

১. বস্তি এলাকায় শিশু বিদ্যালয় পরিচালনা ।

২. অনাথ আশ্রম পরিচালনা ।

সম্প্রীতি তৈরি করতে মাদার তেরেসার অবদান

জন্ম: মাদার তেরেসা ২৬শে আগষ্ট, ১৯১০ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের আলবেনিয়া রাজ্যের স্কপিয়’তে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পরিবার ছিল আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত।

আহ্বান: ১২ বছর বয়সে তিনি ঈশ্বরের কাজের জন্য আহ্বান পেয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাকে খ্রিষ্টের কাজ করার জন্য একজন ধর্মপ্রচারক হতে হবে। ১৮ বছর বয়সে তিনি পিতা-মাতাকে ছেড়ে আয়ারল্যান্ডে ও পরে ১৯২৯ সালে ভারতে আইরিশ নান সম্প্রদায়ের “সিষ্টার্স অব লরেটো” সংস্থায় যোগদান করেন। ডাবলিনে কয়েক মাস প্রশিক্ষণের পর তাকে ভারতে পাঠানো হয়। তিনি ভারতে ১৯৩১ সনের ২৪শে মে সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন পরে ১৯৩৭ সালের ১৪ মে চূড়ান্ত শপথ গ্রহণ করেন।

সেবা কাজ: তিনি কোলকাতার বস্তিতে দরিদ্রতম দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করেন। যদিও তার আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলনা। তিনি বস্তির জন্য একটি উন্মুক্ত স্কুল শুরু করেছিলেন। ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর তেরেজা “ডায়োসিসান ধর্মপ্রচারকদের সংঘ” করার জন্য ভ্যাটিকানের অনুমতি লাভ করেন। এ সমাবেশই পরবর্তীতে “দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। “দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি” হল একটি খ্রিষ্ট ধর্মপ্রচারণা সংঘ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৫০ সালে তিনি “নির্মল শিশু ভবন” স্থাপন করেন। এই ভবন ছিল এতিম ও বসতিহীন শিশুদের জন্য এক ধরণের স্বর্গ। ২০১২ সালে এই সংঘের সাথে যুক্ত ছিলেন ৪,৫০০ জনেরও বেশি সন্ন্যাসিনী। প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তার এই ধর্মপ্রচারণা কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রতিষ্ঠিত চ্যারিটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দরিদ্রদের মধ্যে কার্যকর সহায়তা প্রদান করে থাকে যেমন- বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নেশাগ্রস্ত, গৃহহীনদের জন্য, পারিবারিক পরামর্শদান, অনাথ আশ্রম, স্কুল, মোবাইল ক্লিনিক ও উদ্বাস্তুদের সহায়তা ইত্যাদি। তিনি ১৯৬০ এর দশকে ভারত জুড়ে এতিমখানা, ধর্মশালা এবং কুষ্ঠরোগীদের ঘর খুলেছিলেন। তিনি অবিবাহিত মেয়েদের জন্য তার নিজের ঘর খুলে দিয়েছিলেন।

তিনি এইডস আক্রান্তদের যত্ন নেয়ার জন্য একটি বিশেষ বাড়িও তৈরি করেছিলেন। মাদার তেরেসার কাজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়েছে। তার মৃত্যুর সময় বিশ্বের ১২৩টি দেশে মৃত্যু পথযাত্রী এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষা রোগীদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম ও বিদ্যালয়সহ দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটির ৬১০টি কেন্দ্র চলমান ছিল।

পুরস্কার: মাদার তেরেসা ১৯৬২ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে “ম্যাগসেসে শান্তি পুরস্কার”, ১৯৭২ সালে “জওহরলাল নেহেরু পুরস্কার” এবং ১৯৭৮ সনে “বালজান পুরস্কার” লাভ করেন। মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সনে দুঃখী মানবতার সেবাকাজের স্বীকৃতিস্বরূপ “নোবেল শান্তি পুরস্কার” অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান “ভারতরত্ন” লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে “প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম পুরস্কার” লাভ করেন। ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে একটি অনুষ্ঠানে পোপ ফ্রান্সিস তাকে “সন্ত” হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং ক্যাথলিক মিশনে তিনি “কোলকাতার সন্ত তেরেসা” নামে আখ্যায়িত হন।

মৃত্যু: তিনি ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ ৮৭ বছর বয়সে কোলকাতার পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন।

সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সুফল

সদাচারের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি চর্চার অনেক সুফল রয়েছে। যেমন -

১. মানুষ সুখে-শান্তিতে নির্ভয়ে বসবাস করতে পারে।

২. নিজের কল্যাণ কামনার সাথে সাথে সকল প্রাণীরও কল্যাণ কামনা করে।

৩. সকল মানুষকে কল্যাণমিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।

৪. সকল মানুষ ও প্রাণীর প্রতি মৈত্রীময় আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়।

৫. হিংসা-বিদ্বেষ এবং ভেদাভেদ দূর হয়।

যাদের মনে হিংসা-বিদ্বেষ-ক্রোধ প্রভৃতি অকুশল মনোবৃত্তি থাকে তারা শত্রুহীন হয়ে সুখে বসবাস করতে পারে। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ বলেছেন :

অক্কোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনি মং, অহাসি মে',

যে চ তং ন উপনযহন্তি, বেরং তেসং ন সম্মতি।

অর্থাৎ যারা, ‘আমাকে তিরস্কৃত, প্রহৃত ও পরাজিত করল এবং আমার সম্পদ হরণ করল'- এরকম চিন্তা পোষণ করে, তাদের বৈরীভাব কখনো প্রশমিত হয় না। তাই বুদ্ধ সর্বদা হিংসা-বিদ্বেষ-ক্রোধ প্রভৃতি অকুশল মনোবৃত্তি পরিত্যাগ করে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাসের উপদেশ দিয়েছেন।

গৌতম বুদ্ধ তাঁর বাণীতে কোনো নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম সম্প্রদায় বা ব্যক্তির কথা বলেননি। তিনি সর্বক্ষেত্রে সর্ব সত্তার কথা বলেছেন। সর্বজনীন মঙ্গলের কথা বলেছেন। তাঁর বাণীর মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, সম্প্রদায় গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ আন্তরিকতা প্রদর্শনের কথা বলা হয়নি। সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী তথা মানবজাতিসহ সকল প্রাণীর প্রতি সর্বতোভাবে অন্তঃপ্রাণ ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ সকলের মধ্যে আন্তরিক ও প্রাণের সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।

আমাদের উচিত সম্প্রীতি চর্চার মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি আন্তরিক ও মানবিক সম্পর্ক তৈরি করা, ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা। তাহলে আমরা সকলে সুখে শান্তিতে নির্ভয়ে বসবাস করতে পারব।

 

অংশগ্রহণমূলক কাজ : ৪৫

সম্প্রীতি তৈরি করতে করণীয় সম্পর্কে একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করো। কর্ম পরিকল্পনাটি নিজ বিদ্যালয় বা পরিবারে প্রয়োগ করো। যেমন, শ্রেণিকক্ষ বা বিদ্যালয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি, সেবামূলক কর্মকাণ্ড,পরিবারে সহযোগিতা করা ইত্যাদি।

 

     এসো সম্প্রীতি গড়ি

সুখে-শান্তিতে বসবাস করি।

Content added By
Promotion